ঝুঁকিপূর্ণভাতাসহ একগুচ্ছ দাবি পুলিশের, নির্বাচনের আগে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহবান জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

- আপডেট সময় : ০১:১৯:২৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
- / ৬৩ বার পড়া হয়েছে
অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের পুলিশ সপ্তাহ ছিলো কিছুটা ভিন্নতর। কোন রাক-ঢাক নাই। অনেকটা সাদা-মাটা। নিরাপত্তায় রাখতে হয়নি পুরো রাজারবাগের আশ-পাশ। কিংবা পাশ্ববর্তী উচু বিল্ডিংগুলোর ছাদে বসে কড়া পাহারাও দিতে হয়নি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে। বন্ধ রাখতে হয়নি আশ-পাশের কোন রাস্তা। সাধারণ মানুষ যেন বুজতেই পারেননি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এতো বড় একটি অনুষ্ঠান হয়ে গেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে।
পুলিশ সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার কাছে পুলিশ বাহিনী খুবই সাবলীল ভঙ্গিমায় বলতে পেরেছেন নিজেদের মনের কথা। ভালোকাজের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রসংশিত হয়েছেন সাধারণ কনস্টেবল রিয়াদ।
দাবি উঠেছে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, ঝুঁকিভাতা, ছুটি, প্রমোশন, স্বামী-স্ত্রীকে একই কর্মস্থলে পদায়নের। সেখানে কিছু দাবি মানার আশ্বাসও মিলেছে। তবে ভিআইপি প্রটোকল কমানো ও পুলিশে লাল গালিচা বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত এসেছে।
প্রথম দিন মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ছুটি ও প্রণোদনার দাবি তুলে ধরেন ঢাকা জেলার কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা। তিনি বলেন, অন্য বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ১২৯ দিন ছুটি ভোগ করেন। কাজের ধরন ও চাপের কারণে পুলিশ সদস্যরা কখনো এই ছুটি ভোগ করতে পারেন না। তাই এই সময় কর্মকাল হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের কমপক্ষে ৩০ দিন বা এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণ ভাতা দেওয়া হোক।
এসময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ সদস্যের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কাছ থেকে কিছু প্রাথমিক বক্তব্য শুনলাম। শুনে বুঝতে পারলাম যে অনেকগুলো কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। যেটা আমাদের পক্ষ থেকে করার কথা ছিল, তা হয়নি। এর আগে আমরা একবার নিজেদের মধ্যে বসেছিলাম। আমার কাছে খুবই খারাপ লাগছিল। কী রকম পরিস্থিতিতে আপনাদের কাজ করতে হয়, তা আমার জানা ছিল না। আপনাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কত কঠিন, সেটার মাত্রা কত গভীর।
ড. ইউনূস বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আশা করি তা বাস্তবায়ন হয়েছে। কতদূর হয়েছে, সেটা আবার খোঁজ নেবো। আমরা আজ আবার বসবো যাতে আপনাদের কাজের সহায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। আপনারা যেন কাজে উৎসাহ পান এবং পরিস্থিতি সহায়ক হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রধান উপদেষ্টা ধৈর্য সহকারে পুলিশের দাবি-দাওয়াগুলো শোনেন এবং তিনি দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন।
এরপর দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে পুলিশ সদস্যরা আরও বেশ কয়েকটি জরুরি দাবি তুলে ধরেন।েএরমধ্যে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত ঝুঁকিভাতা চালু করা, থানা ও ফাঁড়িগুলোতে আবাসন সমস্যার সমাধান করা, ট্রেনিং একাডেমিতে ভাতা চালু করা, নারী প্রশিক্ষণ সেন্টার বাড়ানো, পুলিশ সদস্যদের পোস্টিং (স্বামী/স্ত্রী একই কর্মস্থলে পদায়ন), এএসপি পদে নিয়োগ বিধি সংশোধন, সরকারিভাবে ট্রাফিক বক্স স্থাপন এবং নারী ট্রাফিকের জন্য নারীবান্ধব টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ, বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের মান উন্নয়ন, পুলিশের বাজেট দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ার প্রস্তাব, ফোর্স বাড়িয়ে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, একই পদে দীর্ঘদিন চাকরি করার পর অবসরের আগে পদোন্নতি দেওয়াসহ (কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত) বিবিধ প্রস্তাব ছিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে
এসব দাবিকে যৌক্তিক মনে করছেন বলে জানালেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, কনস্টেবল থেকে এসআইদের ঝুঁকিভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ সীমা (সিলিং) বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ফলে নিচের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আগের চেয়ে অধিক হারে ঝুঁকিভাতা পাবেন। পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল কেনার জন্য ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে পুলিশের এসআই ও এএসআইদের এ ঋণ দেওয়া হবে। সরকার যাতে ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করে- সে বিষয়েও অনুরোধ জানানো হবে।
তিনি বলেন, অধস্তন পুলিশ সদস্যদের নিজেদের বৃহত্তর জেলার মধ্যে পদায়নের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজন পুলিশ সদস্য হলে তাদের একই জেলায় পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পুলিশের জনবল সংকট রয়েছে। তাই তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে (টিওএন্ডই) জনবল বাড়ানো দরকার। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভিআইপি ও মন্ত্রীরা যাতায়াতে পুলিশের যে প্রটোকল পান সেসব প্রটোকল কমাতে হবে। এছাড়া পুলিশে লাল গালিচা সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে।
পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সবার উদ্দেশ্যে আরও বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারও কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নেওয়া যাবে না। ঘুষ, দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার, সেবার মানসিকতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হবে। এর মাধ্যমে পুলিশের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সাধারণ মানুষ যেন কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয়- সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এর আগে সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, সে সময় এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব রকমের ব্যবস্থা নিয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ নিরসন, বিশেষ অভিযান পরিচালনা অংশীজনদের সঙ্গে পুলিশের আন্তঃযোগাযোগ জোরদার করা, পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশের মানুষ পুলিশ বাহিনীকে খুবই শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে চায় বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তিনি নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সংবেদনশীল হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পুলিশ সপ্তাহেও ড. ইউনূস আসন্ন নির্বাচনের বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে দেশের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচনের আগের সময়টা অত্যন্ত কঠিন সময় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, পরাজিত শক্তি যেন কোনোভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে।