ঢাকা ১০:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

থমকে আছে এনএসসি দূর্ণীতির তদন্ত প্রতিবেদন, বরাদ্ধও বাতিল হয়নি,সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০৯:২৮:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
  • / ৪৮ বার পড়া হয়েছে
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ক্রীড়া উপদেষ্টার দ্বায়িত্ব গ্রহনের পরেই ক্রীড়াঙ্গনকে পরিশুদ্ধ করার আওয়াজ তুলেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা তরুণ তুর্কী আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া। ক্রীড়াঙ্গনে দূর্নীতির পাহাড় দেখে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের সবচে বড় অনিয়ম এবং দূর্নীতি দেখতে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিনস্ত বিভিন্ন দোকান ও স্থাপনা বরাদ্ধে। জানতে পেরেছেন এই অনিয়মগুলোর দীর্ঘ পথ চলার ধরণ। বিশেষ করে দোকানও স্থাপনা বরাদ্ধে  রাজ্যের অনিয়ম উঠেছে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। সেখানে সবকিছু প্রকাশ পাওয়ার পরও যুব ও ক্রড়ামন্ত্রণালয় থেকে কোন ধরণের পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্রীড়াঙ্গনে চলছে বিরুপ সমালোচনা। ৫টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে আরও খতিয়ে দেখার নামে কালক্ষেপন করাকে আড় চোখে দেখছেন সমালোচকরা, তাহলেেএখানেই থমকে গেলো সব কিছু! এতোদিনে কেন বাতিল হয়নি অনিয়মভাবে বরাদ্ধ পাওয়া দোকান কিংবা বাড়েনি কেন ভাড়া। দোকানিরা আগের মতোই সব ঠিকঠাক ভাবে চালাচ্ছেন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এই অনিয়ম যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত তদন্ত কমিটি এ ধরনের অনিয়মের ঘটনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যাচাই করছে। কমিটি যেসব অনিয়মের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তার মধ্যে আছে নিয়ম না মেনে দোকান বরাদ্দ দেওয়া, ঊর্ধ্বে চারবার পর্যন্ত একই দোকানের ইজারা বদল, জরুরি পরিষেবার অপব্যবহার, অবৈধ দখলদারি ও আর্থিক নথিতে গরমিল।

গত বছরের নভেম্বরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটি ১৩ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এনএসসি কর্মকর্তারা এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারবেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এনএসসির কর্মকর্তা, স্টেডিয়াম প্রশাসন ও দোকান মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় সংক্রান্ত অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দোকান বরাদ্ধের মালিকদের যোগসাজসে এই অনিয়ম ও দূর্নীতিগুলো চলছে। এরফলে সরকার বিশাল অংকের আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অথচ অর্থাভাবে ফেডারেশনগুলো চলতে পারছে না। টুর্নামেন্ট হতে পারছে না, মাঠের সংস্কার হয় না। অথচ বছরের পর বছর এভাবে হাজার  হাজার কোটি টাকা চুরি হচ্ছে। এমন তথ্য গনমাধ্যম কর্মীদের সামনে তুলে ধরেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা। অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখার কথাও তিনি জানিয়েছিলেন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিনে সারাদেশে ১০৭৪টি দোকান ও স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামেই ২৯৬টি দোকান বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দোকান ভাড়া থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোষাগারে জমা পড়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এই অর্থকে যদি ১৫গুন করা হয় তাহলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বছরে আয় হওয়ার কথা শতকোটি টাকার উপরে। এই আয় দিয়েই ক্রীড়াঙ্গনের ফেডারেনগুলোর অর্থ বরাদ্দ এবং টুর্নামেন্টে পরিচালনায় কোন প্রকার অসুবিধা হবার কথা না। উল্টো আরো টাকা কোষাগার থেকে যাবার কথা। এভাবে গত পনের বছরে কি পরিমান টাকার অনিয়ম হয়েছে সেটা কেবল আরো পনের দিয়ে গুণন করলেই পরিস্কার হয়ে যাবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এসব অপরাধ তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নয়টি মার্কেটই রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। সব মিলিয়ে এগুলোতে এক হাজার ৭৪টি দোকান রয়েছে।

দূর্ণীতির একটি উদাহরণস্বরুপ,  বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ৮১২ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির মূল ইজারাদার শামসুর রহমান গং প্রতি মাসে সরকারকে মাত্র ২১ হাজার ৯৩৪ টাকা ভাড়া দিলেও তিনি যে চতুর্থ পক্ষের কাছে ইজারা দিয়েছেন, তার কাছ থেকে তিনি মাসে তিন লাখ টাকা ভাড়া আদায় করে থাকেন। এর মানে হলো বাড়তি ১৩ গুণ ভাড়া থেকে এনএসসি এক পয়সাও উপার্জন করে না।
একইভাবে, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের ১৫৬ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির ইজারাদার মো. জামাল হোসেন মাত্র চার হাজার ৩৫৭ টাকা ভাড়া দেন সরকারকে। অপরদিকে, বর্তমানে যিনি ওই দোকানটি পরিচালনা করছেন, তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দেন। এনএসসির নয়টি মার্কেটেই এ ধরনের অনিয়মের নজিরের অভাব নেই।

প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ এক দশক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৩ সালে গঠিত এনএসসির দোকান বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ ২০১৬ সালে উত্তীর্ণ হলেও নতুন করে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে ২০১৫ সালের পর থেকে দেওয়া কোনো বরাদ্দের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম-নীতি মানা হয়নি।

এনএসসির নীতি অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর ভাড়া পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হলেও কমিটি উল্লেখযোগ্য হারে ভাড়া বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে ইজারাদারদের নিজেদের পকেট ভারী হলেও এনএসসির আদায় করা আয়ের পরিমাণ বাড়েনি।

এই কারণে আয়ের হিসাব নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। পে অর্ডার, আয়-ব্যয় সংক্রান্ত বিবৃতি ও মার্কেট-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতির মধ্যে গরমিল চিহ্নিত করার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি, নতুন বা খালি জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক হলেও এই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের ৩১টি দোকানের অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রতিবেদনে অন্যান্য অনিয়মের মধ্যে রয়েছে এনএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতির বিষয়টিও। চার বা তার চেয়েও বেশি অংশের দোকানের মালিকানা এই সমিতির হাতে, যা এনএসসির নীতির পরিপন্থি বলে জানা গেছে। আর্থিক বিষয়গুলো ছাড়াও এই তদন্তে সরকারি অবকাঠামোর গুরুতর অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।

মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সিঁড়িগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ধোয়ার কাজে স্টেডিয়ামের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অননুমোদিত ব্যবহারকারীদের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা অবৈধ। কমলাপুরে এনএসসির কর্মচারীদের ১৬-১৭টি পরিবার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। পাশাপাশি, সেখানে দোকান মালিকদের সংগঠন অবৈধভাবে কার্যালয় পরিচালনা করছে, যার কোনো আনুষ্ঠানিক বরাদ্দ নেই। সংগঠনটি অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত।

জাতীয় স্টেডিয়াম, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়ামে অনিয়মই যেন নিয়ম। সেখানকার দোকানদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা কেউ নি য়ম  অনুযায়ী সরাসরি এনএসসির কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেননি। পরিবর্তে, তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা এমনকি চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকেও দোকান ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

এ সব বিষয় তদন্তের পর যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রণালয় আরও অনুসন্ধান ও সমস্যা সমাধানের জন্য ৫টি কমিটি গঠন করেছে। এনএসসির সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে আছে বরাদ্দ প্রক্রিয়ার অটোমেশন, নিয়মিত অডিট পরিচালনা ও প্রচলিত নীতিমালার নিরীক্ষা। কিন্তু এতো সব তথ্য প্রকাশিত হবার পরও দোকানের ইজারা বাতিল হয়নি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে কেবল অনিয়মের অংশবিশেষ সামনে এসেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও এনএসসি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়া চালু থেকেছে।’
এ বিষয়টিতে দুদকের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা সামনে আছেন, শুধু তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং যারা নেপথ্যে থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন এবং এসব অনিয়ম থেকে বছরের পর বছর ফায়দা লুটেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও মন্ত্রণালয়কে এখন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

থমকে আছে এনএসসি দূর্ণীতির তদন্ত প্রতিবেদন, বরাদ্ধও বাতিল হয়নি,সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক

আপডেট সময় : ০৯:২৮:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

ক্রীড়া উপদেষ্টার দ্বায়িত্ব গ্রহনের পরেই ক্রীড়াঙ্গনকে পরিশুদ্ধ করার আওয়াজ তুলেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা তরুণ তুর্কী আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া। ক্রীড়াঙ্গনে দূর্নীতির পাহাড় দেখে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের সবচে বড় অনিয়ম এবং দূর্নীতি দেখতে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিনস্ত বিভিন্ন দোকান ও স্থাপনা বরাদ্ধে। জানতে পেরেছেন এই অনিয়মগুলোর দীর্ঘ পথ চলার ধরণ। বিশেষ করে দোকানও স্থাপনা বরাদ্ধে  রাজ্যের অনিয়ম উঠেছে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। সেখানে সবকিছু প্রকাশ পাওয়ার পরও যুব ও ক্রড়ামন্ত্রণালয় থেকে কোন ধরণের পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্রীড়াঙ্গনে চলছে বিরুপ সমালোচনা। ৫টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে আরও খতিয়ে দেখার নামে কালক্ষেপন করাকে আড় চোখে দেখছেন সমালোচকরা, তাহলেেএখানেই থমকে গেলো সব কিছু! এতোদিনে কেন বাতিল হয়নি অনিয়মভাবে বরাদ্ধ পাওয়া দোকান কিংবা বাড়েনি কেন ভাড়া। দোকানিরা আগের মতোই সব ঠিকঠাক ভাবে চালাচ্ছেন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এই অনিয়ম যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত তদন্ত কমিটি এ ধরনের অনিয়মের ঘটনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যাচাই করছে। কমিটি যেসব অনিয়মের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তার মধ্যে আছে নিয়ম না মেনে দোকান বরাদ্দ দেওয়া, ঊর্ধ্বে চারবার পর্যন্ত একই দোকানের ইজারা বদল, জরুরি পরিষেবার অপব্যবহার, অবৈধ দখলদারি ও আর্থিক নথিতে গরমিল।

গত বছরের নভেম্বরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটি ১৩ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এনএসসি কর্মকর্তারা এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারবেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এনএসসির কর্মকর্তা, স্টেডিয়াম প্রশাসন ও দোকান মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় সংক্রান্ত অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দোকান বরাদ্ধের মালিকদের যোগসাজসে এই অনিয়ম ও দূর্নীতিগুলো চলছে। এরফলে সরকার বিশাল অংকের আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অথচ অর্থাভাবে ফেডারেশনগুলো চলতে পারছে না। টুর্নামেন্ট হতে পারছে না, মাঠের সংস্কার হয় না। অথচ বছরের পর বছর এভাবে হাজার  হাজার কোটি টাকা চুরি হচ্ছে। এমন তথ্য গনমাধ্যম কর্মীদের সামনে তুলে ধরেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা। অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখার কথাও তিনি জানিয়েছিলেন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধিনে সারাদেশে ১০৭৪টি দোকান ও স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামেই ২৯৬টি দোকান বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দোকান ভাড়া থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোষাগারে জমা পড়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এই অর্থকে যদি ১৫গুন করা হয় তাহলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বছরে আয় হওয়ার কথা শতকোটি টাকার উপরে। এই আয় দিয়েই ক্রীড়াঙ্গনের ফেডারেনগুলোর অর্থ বরাদ্দ এবং টুর্নামেন্টে পরিচালনায় কোন প্রকার অসুবিধা হবার কথা না। উল্টো আরো টাকা কোষাগার থেকে যাবার কথা। এভাবে গত পনের বছরে কি পরিমান টাকার অনিয়ম হয়েছে সেটা কেবল আরো পনের দিয়ে গুণন করলেই পরিস্কার হয়ে যাবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এসব অপরাধ তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের (দুদক) প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। নয়টি মার্কেটই রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। সব মিলিয়ে এগুলোতে এক হাজার ৭৪টি দোকান রয়েছে।

দূর্ণীতির একটি উদাহরণস্বরুপ,  বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ৮১২ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির মূল ইজারাদার শামসুর রহমান গং প্রতি মাসে সরকারকে মাত্র ২১ হাজার ৯৩৪ টাকা ভাড়া দিলেও তিনি যে চতুর্থ পক্ষের কাছে ইজারা দিয়েছেন, তার কাছ থেকে তিনি মাসে তিন লাখ টাকা ভাড়া আদায় করে থাকেন। এর মানে হলো বাড়তি ১৩ গুণ ভাড়া থেকে এনএসসি এক পয়সাও উপার্জন করে না।
একইভাবে, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের ১৫৬ বর্গফুট আয়তনের দোকানটির ইজারাদার মো. জামাল হোসেন মাত্র চার হাজার ৩৫৭ টাকা ভাড়া দেন সরকারকে। অপরদিকে, বর্তমানে যিনি ওই দোকানটি পরিচালনা করছেন, তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দেন। এনএসসির নয়টি মার্কেটেই এ ধরনের অনিয়মের নজিরের অভাব নেই।

প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ এক দশক আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৩ সালে গঠিত এনএসসির দোকান বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ ২০১৬ সালে উত্তীর্ণ হলেও নতুন করে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে ২০১৫ সালের পর থেকে দেওয়া কোনো বরাদ্দের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম-নীতি মানা হয়নি।

এনএসসির নীতি অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর ভাড়া পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হলেও কমিটি উল্লেখযোগ্য হারে ভাড়া বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে ইজারাদারদের নিজেদের পকেট ভারী হলেও এনএসসির আদায় করা আয়ের পরিমাণ বাড়েনি।

এই কারণে আয়ের হিসাব নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। পে অর্ডার, আয়-ব্যয় সংক্রান্ত বিবৃতি ও মার্কেট-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতির মধ্যে গরমিল চিহ্নিত করার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি, নতুন বা খালি জায়গা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক হলেও এই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের ৩১টি দোকানের অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রতিবেদনে অন্যান্য অনিয়মের মধ্যে রয়েছে এনএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতির বিষয়টিও। চার বা তার চেয়েও বেশি অংশের দোকানের মালিকানা এই সমিতির হাতে, যা এনএসসির নীতির পরিপন্থি বলে জানা গেছে। আর্থিক বিষয়গুলো ছাড়াও এই তদন্তে সরকারি অবকাঠামোর গুরুতর অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।

মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সিঁড়িগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ধোয়ার কাজে স্টেডিয়ামের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং অননুমোদিত ব্যবহারকারীদের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা অবৈধ। কমলাপুরে এনএসসির কর্মচারীদের ১৬-১৭টি পরিবার মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। পাশাপাশি, সেখানে দোকান মালিকদের সংগঠন অবৈধভাবে কার্যালয় পরিচালনা করছে, যার কোনো আনুষ্ঠানিক বরাদ্দ নেই। সংগঠনটি অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত।

জাতীয় স্টেডিয়াম, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়ামে অনিয়মই যেন নিয়ম। সেখানকার দোকানদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা কেউ নি য়ম  অনুযায়ী সরাসরি এনএসসির কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেননি। পরিবর্তে, তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা এমনকি চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকেও দোকান ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।

এ সব বিষয় তদন্তের পর যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রণালয় আরও অনুসন্ধান ও সমস্যা সমাধানের জন্য ৫টি কমিটি গঠন করেছে। এনএসসির সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে আছে বরাদ্দ প্রক্রিয়ার অটোমেশন, নিয়মিত অডিট পরিচালনা ও প্রচলিত নীতিমালার নিরীক্ষা। কিন্তু এতো সব তথ্য প্রকাশিত হবার পরও দোকানের ইজারা বাতিল হয়নি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে কেবল অনিয়মের অংশবিশেষ সামনে এসেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও এনএসসি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর এই প্রক্রিয়া চালু থেকেছে।’
এ বিষয়টিতে দুদকের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা সামনে আছেন, শুধু তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং যারা নেপথ্যে থেকে এই প্রক্রিয়া চালু রেখেছেন এবং এসব অনিয়ম থেকে বছরের পর বছর ফায়দা লুটেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও মন্ত্রণালয়কে এখন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’