ঝড়ো বেগে বাড়ছে ডেঙ্গু,সতর্ক থাকার আহবান

- আপডেট সময় : ০৮:৫৬:৩৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
- / ৪১ বার পড়া হয়েছে
সময়টা এখন বৃষ্টির। প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হচ্ছে দেশব্যাপী। আর সেই বৃষ্টির পানি জমে থাকা মানেই সেখানে এডিস মশার নিরাপদ বাসস্থান। জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে আর যখনি তাপের তীব্রতা বাড়তে থাকে ডিম থেকে মশায় রুপান্তরিত হয়। আর সেই মশা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রে। যে মশার কামড়ে শরীরে ডেঙ্গু রোগের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছর ডেঙ্গুতে শতশত মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ভয়াবহ দূর্যেোগও বটে। তবে দেশের মানুষ এবং সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে সিটি কর্পোরেশনগুলো যদি সচেতন থাকে, গ্রাম ও শহর পরিচ্ছন্ন রাখে তাহলে এর প্রাদুর্ভাব শুরুতেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই একটি জায়গা আমাদের সর্বত্রেই অচেতনতা লক্ষণীয়। যার ফলে বছরের এই সময়গুলোতে আমাদের দেশের নাগরিকদের বেশ আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।
এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় মূলত ফ্রেব্রুয়ার,মার্চ থেকে। ধীরগতিতে শুরু হওয়ার এডিস মশা বাহিত এই রোগ ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌছে যায়। গত একমাসের হিসাব কষলে দেখা যাবে দ্বিগুনেরও বেশি এডিস মশা বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে সাধারণ জনগন। গতকাল একদিনেই ২৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই সবচেয়ে বেশি। বরিশাল বিভাগে ১৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
যদিও এইদিন কোন রোগীর মৃত্যু হয়নি।
মঙ্গলবার (১৭ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া তথ্য মতে, বরিশাল বিভাগে ১৩৮জন,চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ২৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৩২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ২৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
বরগুনা সদর হাসপাতালে ৫০টি শয্যা ডেঙ্গুর জন্য বরাদ্দ। গতকাল এখানে রোগীর সংখ্যা ছিল ১৯২।
এ মাসে (জুন) প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২৪৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন একজন। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ডেঙ্গু বেড়েছে তার আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে। চলতি জুন মাসের প্রথম ১৫ দিন যত রোগী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তা আগের মাসের আক্রান্তের প্রায় সমান।
দেশে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৫ হাজার ৯৮৮। মার্চ মাস থেকে ডেঙ্গু বাড়তে থাকে দেশে। ওই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৬ জন। পরের মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০১। মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা হয় ১ হাজার ৭৭৩। এ মাসে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বাড়ে সংখ্যা। চলতি জুন মাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৬৪৩।
গত বছর দেশে অন্তত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এমন দ্বিগুণ সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেনি। দেশে এ এযাবৎকালের সর্বোচ্চ সংক্রমণের বছর ২০২৩ সালের মে মাসের চেয়ে জুনে এক লাফে পাঁচ গুণ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। গত বছর ডেঙ্গু বেশি বাড়তে থাকে আগস্ট মাস থেকে। এখন চলতি বছরের জুন মাসে আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েক মাসের দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি কি এটাই ইঙ্গিত করে যে এবারও ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বাড়বে?
যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির মশাবাহিত রোগের গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সংখ্যা বা প্রবণতা দেখে বলার উপায় নেই যে ডেঙ্গু বাড়বে। তবে এটা ঠিক যে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু রোধে আমরা আসলে কিছুই করিনি। তাই এবার যে বাড়বে না, তা–ও বলা যায় না।’
দিন দিন রোগী বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে তাদের করণীয় অনেকটাই কম বলে দাবি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক হালিমুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘আমরা রোগনিয়ন্ত্রণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু মশার উৎস বন্ধ না হলে রোগী বন্ধ হবে না। প্রজননক্ষেত্র বেড়ে যাবে। মশার প্রজননক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই। এটা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কাজ।’
দেশে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্তের ২৩ শতাংশ ঢাকার দুই সিটিতে। বাকি আক্রান্তরা ঢাকার বাইরের। দেশের মোট আক্রান্তের ৪৫ শতাংশই বরিশাল বিভাগের। এ বিভাগের বরগুনায় দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় এক–চতুর্থাংশ।
নাগরিক সংগঠন বরগুনা জেলা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান সম্প্রতি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শহরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক স্থানে ময়লা-আবর্জনা আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে জোরদার কোনো পদক্ষেপ নেই। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারে কোনো জনপ্রতিনিধিরা নেই। আগে যখন ছিলেন, তখন যে খুব ভালো অবস্থা ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু একটা ন্যূনতম জবাবদিহি ছিল। এখন যাঁরা আছেন, তাঁরা রুটিন কাজ করেন।
চলতি বছরের আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অনেকটাই অনুকূলে বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, মে মাসে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। জুন মাসে তাপপ্রবাহ থাকলেও অনেক স্থানেই বৃষ্টি হচ্ছে। এ মাসে আবার একটি নিম্নচাপের পূর্বাভাস রয়েছে।
তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে এবং বায়ুমণ্ডলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ আর্দ্রতা থাকলে তা এডিস মশা প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী আবহাওয়া। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কোনো কোনো দিন ১০০ শতাংশ থাকছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক।
সাধারণত একটি এডিস মশার ডিম পাড়তে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। কিন্তু বৃষ্টি ও আর্দ্রতার পরিমাণ এখনকার মতো অবস্থায় থাকলে এই সময় চার থেকে পাঁচ দিনে কমে আসতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলছিলেন, মশাকে তার উৎসেই নির্মূল করতে হবে। কিন্তু সেই চেষ্টাই তো নেই। সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য স্থানে মশা নির্মূলের দায়িত্বে থাকা লোকজন কিউলেক্স মশা মারার কাজে এত দিন নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ডেঙ্গুর বাহক এডিসের নির্মূল কৌশল ভিন্ন রকম। তা তাঁদের জানা নেই।
তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে এবং বায়ুমণ্ডলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ আর্দ্রতা থাকলে তা এডিস মশা প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী আবহাওয়া।
এই অনুকূল পরিবেশ এবং ব্যবস্থাপনার অভাব—এই দুয়ে মিলে পরিস্থিতি এবার জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম। তার মতে, ঘন ঘন বৃষ্টি, আবার গরম পড়ছে, এতে এডিস মশা বিস্তারের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে, এই মশা নির্মূলে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে।
এবার ঈদের ছুটিতে সবাই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটে যায়। ৫/৭দিন থাকার পর ঢাকায় ফিরেছেন। এরই ফাঁকে এডিস মশা ভালোভাবেই বিস্তার লাভ করেছে। সব মিলে এ থেকে রক্ষা পেতে হলে সিটি কর্পোরেশনগুলোর পাশাপাশি দেশের জনগনকেও সচেতন হওয়া বিকল্প কিছুই নেই। তবেই এ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা মিলবে।