চূড়ান্ত অনুমোদন পেলো ৩ গুরুত্বপূর্ণ আইন, ২৫বার খসড়া আইন পরিবর্তন করা হয় সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট

- আপডেট সময় : ১২:৫৩:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৭ মে ২০২৫
- / ৩৯ বার পড়া হয়েছে
রাষ্ট্রীয় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আইন অনুমোদন দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। খসড়া ও চূড়ান্ত অনুমোদনপ্রাপ্ত আইনগুলো হচ্ছে-সাইবার নিরাপত্তা আইন, সিভিল প্রসিডিওর অ্যাক্ট (সিপিসি) এবং সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ। এই তিন আইনের মধ্যে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদনের আগে মোট ২৫ বার খসড়া আইন পরিবর্তন করা হয়।
আইন বিচার ও সংসদীয় বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, তার জানামতে বাংলাদেশে এ আইনটির মতো কোনো আইন নিয়ে এত কনসালটেশন হয়নি। এছাড়া সংসদীয় নির্বাচনে এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত আইনের সংশোধনের অনুমোদনের ফলে নির্বাচন কমিশন সীমানা পুনর্নির্ধারণ শিগগির শুরু করতে পারবে। এছাড়া সিভিল প্রসিডিউর কোর্ট (সিপিসি) এর চূড়ান্ত অনুমোদনের ফলে এখন আর মামলা নিষ্পত্তির জন্য বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরপাক খেতে হবে না।
মঙ্গলবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে এ তিনটি আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিনি জানান, সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই আগের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে যুগোপযোগী একটি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন সময় অ্যাক্টটির ড্রাফট করা হয়।
আসিফ নজরুল বলেন, আইনটি প্রণয়নে প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ অনেক কষ্ট করেছেন। এছাড়া প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়সহ সবাই মিলে অনেক পরামর্শ সভা করে। সর্বশেষ এ আইনের যারা সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিল তাদের সঙ্গে (সিভিল সোসাইটির সদস্য) তিন ঘণ্টা একসঙ্গে বসে আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়।
খসড়া অনুমোদনের পর এখন আইন মন্ত্রণালয়ে ব্যাটিং হবে, তারপর গেজেট নোটিফিকেশন হবে। এ সপ্তাহের মধ্যে হয়ত চূড়ান্তভাবে প্রয়োগযোগ্য আইনের পরিণত হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ, সাইবার স্পেসে নারী শিশু বিষয়ক যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এছাড়া আগের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৯ টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। এ নয়টি ধারাই ছিল কুখ্যাত ধারা। এ ধারায় ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের হয়েছিল। এ মামলাগুলো এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া কিছু কিছু আর্টিকেলে পরিবর্তন করা হয়েছে। কথা বলে বা মতামত প্রকাশ করে যে অপরাধ সেখানে মাত্র দুটি অপরাধ রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কনটেন্ট প্রকাশ বা হুমকি দেওয়া। আরেকটা হচ্ছে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর মধ্যে দিয়ে সহিংসতাকে উসকে দেওয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবারের মতো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে যদি কোনো প্রকার সাইবার অপরাধ করা হয় তাহলে তাকে শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ধরনের মামলা কারো বিরুদ্ধে হলে সেটি আমলি আদালতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যাবে। যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি যদি দেখেন মামলায় কোনো মেরিট নেই তাহলে তিনি প্রি ট্রায়াল স্টে মামলা বাতিল করে দিতে পারবেন। এছাড়া অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য অপরাধ রাখা হয়েছে ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপসযোগ্য রাখা হয়েছে।
বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে অনেকগুলো আইন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর ও কুৎসামূলক প্রচারণা বন্ধ সংক্রান্ত বিধানটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এতে হয়রানিমূলক মামলা থেকে বিরত থাকবে।
মানহানিকর তথ্য প্রকাশ প্রচার ইত্যাদির জন্য দণ্ড দেওয়ার যে বিধান তাতে অসংখ্য মামলা হতো। অনেক সাংবাদিকও এ মামলার ভিকটিম হয়েছেন। এ ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এ ধরনের কনটেন্ট বা কথাবার্তা বলার জন্য প্রচুর মামলা হতো। এটাও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আক্রমণাত্মক মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য ও উপাত্ত প্রকাশ ইত্যাদি সম্পর্কিত সব ধারা বাতিল করা হয়েছে।
যে নয়টি ধারা বাতিল হয়েছে সেই ধারায় ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের হতো। এ মামলাগুলো এখন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। নতুন আইনের গেজেট নোটিফিকেশনের আগের দিন পর্যন্ত ওই নয়টি ধারায় যে মামলা থাকবে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
নতুন আইনে জামিনযোগ্য ধারা রাখা হয়েছে। যেমন সাইবার স্পেসে জালিয়াতির অপরাধ, ই-ট্রানজেকশনে অপরাধ, ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং, অশ্লীল বিষয়ক পুস্তক প্রকাশ অর্থাৎ কথা বলে বা মতামত প্রকাশ করে যে অপরাধগুলো হতো সবকিছু জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
এখানে সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল রয়েছে যারা কোনো কনটেন্ট অপসারণ করবে (কোন আক্রমণাত্মক বা অপরাধ মূলক কনটেন্ট থাকে) তার জন্য যে অথরিটি স্থাপন করা হয়েছে সে অথরিটিতে সিভিল সোসাইটির মেম্বার থাকবে।
অথরিটি কোনো কনটেন্ট অপসারণ করার পর ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। আদালত যদি বলে এই কনটেন্ট অপসারণ করা যাবে না তাহলে কনটেন্ট আবার প্রকাশ করতে হবে। আর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালত যদি বলে যে কনটেন্ট অপসারণ করা ঠিক হয়েছে তাহলে তা অপসারণ অবস্থায় থাকবে। এছাড়া যে কনটেন্টটি অপসারণ করা হবে সেটি জনগণকে জানাতে হবে। এর মাধ্যমে জনগণ বুঝতে পারবে সরকার কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপসারণ করেছে নাকি অপসারণ করা ঠিক হয়েছে।
এতে সিভিল প্রসিডিউর (সিপিসি) চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। কিছুদিন আগে সিভিল প্রোসিডিওর কোর্ট (সিপিসি) নীতিগতভাবে অনুমোদন হয়েছিল। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন। বাংলাদেশের সিভিল মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ লাগে। আমরা এখানে অনেকগুলো পরিবর্তন এনেছি। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে আগে ইচ্ছামতো মামলা মুলতবি করা যেত।
এখন আর মুলতবি করা যাবে না। আগে সিপিসির মামলায় আর্জি লিখিত স্টেটমেন্ট দিতো আইনজীবীরা বিভিন্ন শুনানির সময় পড়ে পড়ে শোনাত। সেখানে কনসার্ন ব্যক্তি সম্মতি দিত, তারপর আদালত সেটা শুনতো। শুধুমাত্র আর্জি আর রিটেন স্টেটমেন্ট এটা আদালতে মৌখিকভাবে উত্থাপন করতে করতে দুই তিন বছর পর্যন্ত চলে যেত এমন নজিরও রয়েছে।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, লিখিত আকারে যেটা নেবে সেটাই যথেষ্ট, সেটা আদালতে মৌখিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে না। সিভিল মামলার রায় পাওয়ার পর এক্সিকিউশনের জন্য আবার আলাদা আলাদা মামলা করতে হতো। সেটাও করতে হবে না। সমন জারি করার ক্ষেত্রেও সহজ সাধ্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে করে সিভিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এ আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত
ড. আসিফ নজরুল সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ বিষয়ে বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইচ্ছামতো নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন সংসদীয় এলাকার ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে। বর্তমানে আমাদের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত যে আইন আছে সেখানে ক্লারিকেল একটি ভুলের কারণে এটি নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারছিল না।
নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করেছে তারা যে আইনটি প্রপোজ করেছে, এখন আমরা সেই সংশোধনীটি করে দিয়েছি। এখন সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে সেটা তারা ইচ্ছা করলে এই আইন গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু চার দিনের মধ্যে শুরু করে দিতে পারবে।