ঢাকা ০৬:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

বিমসটেক সম্মেলন থেকে কতোটা স্বস্তির বার্তা নিয়ে ফিরেছেন ড.ইউনুস?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ১২:১৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ এপ্রিল ২০২৫
  • / ৪৯ বার পড়া হয়েছে
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাতেই দেশে ফিরেছেন ড. ইউনুস। দেশে ফেরার আগে থাইল্যান্ডের বিমসটেক সম্মেলনে নতুন দ্বায়িত্ব গ্রহনের ফাঁকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে তিনি বেশ কিছু সফল বৈঠকও সম্পন্ন করেছেন। যা নিয়ে স্বস্তির বাতাস বইছে দেশজুড়ে। ভারত,মিয়ানমার,ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সাথে গভীর আলোচনা হয় ড.ইউনুসের। যা ছিলো অত্যন্ত ফলপ্রসু। যদিও এই বৈঠকের সফলতা নিয়েও সন্দেহের দানা বাঁধছে। তবে বৈঠকেগুলোতে যে ফলাফলের আওয়াজ উঠছে তাতে আপাতত দেশের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্বস্তিদায়ক সফর বলেই মনে হচ্ছে। ভারতের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দানের অগ্রগতি,সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি বন্টন ও দুই দেশের জনগনের জন্য কাজ করার আগ্রহ ছিলো দৃশ্যমান। এক লাখ আশি হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্সনে মায়ানমারের সম্মতি প্রদান, শ্রীলংকা থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাবার অনুরোধ, বুড়িগ্রামে ভুটানের বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

বিশেষ করে পাশবর্তী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর সাথে কি এবং কেমন আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে ছিলো রাজ্যের কৌতুহল। ৫ আগস্টের পর থেকে বন্ধুপ্রীতি এই দুই দেশের সম্পর্ক শুন্যের কোটায় চলে যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় প্রদান, অতপর সেখান থেকে হাসিনার নানা উস্কানিমূলক বক্তব্য বাংলাদেশের সাথে ভারতের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। গত সাতমাসে এই নিয়ে দুইদেশের কুটনীতির জাল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে শুক্রবার বিমসটেক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে দূরত্ব কমানোর পথ বেরিয়ে আসে। দুই দেশের জনগনের জন্য পারস্পারিক সম্পর্ক সোহার্দ বজার রাখার পথ তৈরি হয়।

ইউনুস-মোদী মধ্যকার  প্রায় ৪০ মিনিটের বৈঠকে দুই পক্ষ থেকে বেশ কিছু অভিযোগ ও সর্ম্পক উন্নয়নের বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে  ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে যথেষ্ট মূল্য দেয় বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব পারস্পরিক ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে ভারতের সরকার ও জনগণের অটল সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যকার চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুই দেশের জনগণের কল্যাণে সম্পর্ককে সঠিক পথে নিয়ে যেতে একসঙ্গে কাজ করতে চাই’।

বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে ভারতের সমর্থন চান। তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করার জন্যও আলোচনার আহ্বান জানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন এবং ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানান নরেন্দ্র মোদি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নয়াদিল্লি সবসময় ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে “সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার” দিয়েছে। দুই প্রতিবেশীর ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ প্রধানমন্ত্রী মোদি অধ্যাপক ইউনূসের বিশ্বব্যাপী মর্যাদার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে জনগণের।’

অধ্যাপক ইউনূস মোদির কাছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে বাংলাদেশের অনুরোধের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উসকানিমূলক মন্তব্য করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, যা ভারতে তার আশ্রয়ের সুযোগের অপব্যবহার।’ ‘তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা ও উসকানিমূলক অভিযোগ করে আসছেন,’ বলেন ড. ইউনূস। মোদিকে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ করছি, তাকে (হাসিনা) আপনাদের দেশে থাকাকালে এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিন।’

বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত  জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টেরও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আন্দোলন চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিক্ষোভ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যেমন হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।’

জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বিশেষভাবে ‘নেতৃস্থানীয়দের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং তাদের মরদেহ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য শেখ হাসিনার মন্তব্যকে ঘিরে উত্তেজনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের সম্পর্ক দেশের সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়।’

অধ্যাপক ইউনূস এসময় সীমান্ত হত্যার বিষয়টিও উত্থাপন করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, ‘সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে শুধু অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করবে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘হত্যাকাণ্ড ঘটলে আমি কষ্ট পাই। ভারতকে এই ঘটনাগুলো ঠেকানোর “উপায়” খুঁজে বের করার আহ্বান জানাই।’

জবাবে মোদি বলেন, ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।’ তবে, এ বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির উদ্বেগের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবরগুলো অতিরঞ্জিত এবং এর “বেশিরভাগই ভুয়া” খবর।’

এ বিষয়ে প্রকৃত খবর নিতে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে সাংবাদিক পাঠানোর অনুরোধ করেন, যেন তারা এখানে এসে ‘কথিত এসব হামলার” অনুসন্ধান করতে পারেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি দেশে ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছেন এবং তার সরকার এ ধরনের ঘটনা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। উভয় নেতা একে অপরের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করে বৈঠক শেষ করেন।

এসময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সফল আলোচনার পরেও মায়ানমার ও ভুটানের সাথেও সফল আলোচনা হয়েছে। মায়ানমার বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া প্রায় ৮ লক্ষ্যাধিক আশ্রয়নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবর্তন করতে সম্মত হয়েছে। প্রত্যাশা করা যাচ্ছে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে থেকেই প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। পাশাপাশি আরো আশি হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবর্তনে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) ব্যাংককে ৬ষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ এ তথ্য জানান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে এ তথ্য জানান তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এটি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এই প্রথমবারের মতো এত বড় সংখ্যক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করলো।

মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী জানান, মূল তালিকায় থাকা বাকি প্রায় সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ভারত,মায়ামানরের সাথে বৈঠকের পর ড.ইউনুস শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করেছেন। তাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাঠানোর আহবান জানান। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এদিকে আগ বাড়িয়ে  ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

বিমসটেক সম্মেলন থেকে কতোটা স্বস্তির বার্তা নিয়ে ফিরেছেন ড.ইউনুস?

আপডেট সময় : ১২:১৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ এপ্রিল ২০২৫

রাতেই দেশে ফিরেছেন ড. ইউনুস। দেশে ফেরার আগে থাইল্যান্ডের বিমসটেক সম্মেলনে নতুন দ্বায়িত্ব গ্রহনের ফাঁকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে তিনি বেশ কিছু সফল বৈঠকও সম্পন্ন করেছেন। যা নিয়ে স্বস্তির বাতাস বইছে দেশজুড়ে। ভারত,মিয়ানমার,ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সাথে গভীর আলোচনা হয় ড.ইউনুসের। যা ছিলো অত্যন্ত ফলপ্রসু। যদিও এই বৈঠকের সফলতা নিয়েও সন্দেহের দানা বাঁধছে। তবে বৈঠকেগুলোতে যে ফলাফলের আওয়াজ উঠছে তাতে আপাতত দেশের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্বস্তিদায়ক সফর বলেই মনে হচ্ছে। ভারতের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দানের অগ্রগতি,সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি বন্টন ও দুই দেশের জনগনের জন্য কাজ করার আগ্রহ ছিলো দৃশ্যমান। এক লাখ আশি হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্সনে মায়ানমারের সম্মতি প্রদান, শ্রীলংকা থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাবার অনুরোধ, বুড়িগ্রামে ভুটানের বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

বিশেষ করে পাশবর্তী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর সাথে কি এবং কেমন আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে ছিলো রাজ্যের কৌতুহল। ৫ আগস্টের পর থেকে বন্ধুপ্রীতি এই দুই দেশের সম্পর্ক শুন্যের কোটায় চলে যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় প্রদান, অতপর সেখান থেকে হাসিনার নানা উস্কানিমূলক বক্তব্য বাংলাদেশের সাথে ভারতের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। গত সাতমাসে এই নিয়ে দুইদেশের কুটনীতির জাল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে শুক্রবার বিমসটেক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে দূরত্ব কমানোর পথ বেরিয়ে আসে। দুই দেশের জনগনের জন্য পারস্পারিক সম্পর্ক সোহার্দ বজার রাখার পথ তৈরি হয়।

ইউনুস-মোদী মধ্যকার  প্রায় ৪০ মিনিটের বৈঠকে দুই পক্ষ থেকে বেশ কিছু অভিযোগ ও সর্ম্পক উন্নয়নের বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে  ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে যথেষ্ট মূল্য দেয় বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব পারস্পরিক ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে ভারতের সরকার ও জনগণের অটল সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যকার চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুই দেশের জনগণের কল্যাণে সম্পর্ককে সঠিক পথে নিয়ে যেতে একসঙ্গে কাজ করতে চাই’।

বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে ভারতের সমর্থন চান। তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করার জন্যও আলোচনার আহ্বান জানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন এবং ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানান নরেন্দ্র মোদি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নয়াদিল্লি সবসময় ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে “সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার” দিয়েছে। দুই প্রতিবেশীর ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ প্রধানমন্ত্রী মোদি অধ্যাপক ইউনূসের বিশ্বব্যাপী মর্যাদার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে জনগণের।’

অধ্যাপক ইউনূস মোদির কাছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে বাংলাদেশের অনুরোধের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উসকানিমূলক মন্তব্য করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, যা ভারতে তার আশ্রয়ের সুযোগের অপব্যবহার।’ ‘তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা ও উসকানিমূলক অভিযোগ করে আসছেন,’ বলেন ড. ইউনূস। মোদিকে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ করছি, তাকে (হাসিনা) আপনাদের দেশে থাকাকালে এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিন।’

বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত  জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টেরও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ‘রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, আন্দোলন চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিক্ষোভ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যেমন হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।’

জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বিশেষভাবে ‘নেতৃস্থানীয়দের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং তাদের মরদেহ লুকিয়ে রাখার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য শেখ হাসিনার মন্তব্যকে ঘিরে উত্তেজনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের সম্পর্ক দেশের সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়।’

অধ্যাপক ইউনূস এসময় সীমান্ত হত্যার বিষয়টিও উত্থাপন করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, ‘সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে শুধু অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করবে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘হত্যাকাণ্ড ঘটলে আমি কষ্ট পাই। ভারতকে এই ঘটনাগুলো ঠেকানোর “উপায়” খুঁজে বের করার আহ্বান জানাই।’

জবাবে মোদি বলেন, ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।’ তবে, এ বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির উদ্বেগের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবরগুলো অতিরঞ্জিত এবং এর “বেশিরভাগই ভুয়া” খবর।’

এ বিষয়ে প্রকৃত খবর নিতে তিনি নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে সাংবাদিক পাঠানোর অনুরোধ করেন, যেন তারা এখানে এসে ‘কথিত এসব হামলার” অনুসন্ধান করতে পারেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি দেশে ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছেন এবং তার সরকার এ ধরনের ঘটনা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। উভয় নেতা একে অপরের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করে বৈঠক শেষ করেন।

এসময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সফল আলোচনার পরেও মায়ানমার ও ভুটানের সাথেও সফল আলোচনা হয়েছে। মায়ানমার বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া প্রায় ৮ লক্ষ্যাধিক আশ্রয়নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবর্তন করতে সম্মত হয়েছে। প্রত্যাশা করা যাচ্ছে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে থেকেই প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। পাশাপাশি আরো আশি হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবর্তনে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) ব্যাংককে ৬ষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ এ তথ্য জানান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে এ তথ্য জানান তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এটি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এই প্রথমবারের মতো এত বড় সংখ্যক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করলো।

মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী জানান, মূল তালিকায় থাকা বাকি প্রায় সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ভারত,মায়ামানরের সাথে বৈঠকের পর ড.ইউনুস শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধির সাথে বৈঠক করেছেন। তাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাঠানোর আহবান জানান। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এদিকে আগ বাড়িয়ে  ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছেন।